মানুষের শ্রবণশক্তি এবং দৃষ্টিশক্তির পরীক্ষা

Daily Inqilab জাফর আহমাদ

১৯ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০৬ এএম | আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০৬ এএম

আল্লাহ তা’আলা বলেন,‘আমি মানুষকে এক সংমিশ্রণ বীর্য থেকে সৃষ্টি করেছি। যাতে তার পরীক্ষা নিতে পারি। এ উদ্দেশ্যে আমি তাকে শ্রবণশক্তি এবং দৃষ্টিশক্তির অধিকারী করেছি।’ (সুরা আদ দাহর : ২)। এটাই হলো দুনিয়ায় মানুষের এবং মানুষের জন্য দুনিয়ার প্রকৃত অবস্থান ও মর্যাদা। মানুষ নিছক গাছপালা বা জীব-জন্তুর মত নয় যে, তার সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য এখানেই পূরণ হয়ে যাবে এবং প্রকৃতির নিয়মানুসারে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তার নিজের অংশের করণীয় কাজ সম্পাদন করার পর এখানেই মৃত্যুবরণ করবে এবং নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তাছাড়া এ দুনিয়া তার জন্য আযাব বা শাস্তির স্থান নয় যেমনটা খৃষ্টান পাদ্রীরা মনে করে, প্রতিদানের ক্ষেত্রও নয় যেমনটা জন্মান্তরবাদীরা মনে করে, চরণ ক্ষেত্রে বা বিনোদন কেন্দ্র নয় যেমন বস্তুবাদীরা মনে করে আবার দ্বন্ধ ও সংগ্রাম ক্ষেত্রও নয় যেমন ডারউইন ও মার্কসের অনুসারীরা মনে করে থাকে। বরং দুনিয়া মুলত তার জন্য একটা পরীক্ষাগার।

যে জিনিসকে সে বয়স বা আয়ুস্কাল বলে মনে করে আসলে তা পরীক্ষার সময় যা তাকে এ দুনিয়ায় দেয়া হয়েছে। দুনিয়ায় যে ক্ষমতা ও যোগ্যতা তাকে দেয়া হয়েছে যেসব বস্তুকে কাজে লাগানোর সুযোগ তাকে দেয়া হয়েছে, যে মর্যাদা নিয়ে বা অবস্থানে থেকে সে এখানে কাজ করছে এবং তার ও অন্যান্য মানুষের মধ্যে যে সম্পর্ক বিদ্যমান তার সবই মূল অসংখ্য পরীক্ষপত্র। জীবনের সর্বশেষ মুহুর্ত পর্যন্ত নিরবিচ্ছিন্নভাবে পরীক্ষা চলবে। এ পরীক্ষার ফলাফল দুনিয়ায় প্রকাশ পাবে না। বরং আখেরাতে তার সমস্ত পরীক্ষা পত্র পরীক্ষা ও যাঁচাই-বাচাই করে ফায়সালা দেয়া হবে। সে সফল না বিফল। তার সফলতা ও বিফলতা সবটাই নির্ভর করবে এ বিষয়ের ওপর যে, সে তার নিজের সম্পর্কে কি ধারণা নিয়ে এখানে কাজ করছে এবং তাকে দেয়া পরীক্ষার পত্রসমূহে সে কিভাবে জবাব লিখেছে।

নিজের সম্পর্কে যদি সে মনে করে থাকে যে, তার কোন আল্লাহ নেই অথবা নিজেকে সে বহু সংখ্যক ইলাহর বান্দা মনে করে থাকে এবং পরীক্ষার সবগুলো পত্রে এ বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে জবাব লিখে থাকে যে, আখিরাতে তার ¯্রষ্টার সামনে কোন জবাবদিহি করতে হবে না তাহলে তার জীবনের সমস্ত কর্মকা- ভুল হয়ে গিয়েছে। আর যদি সে নিজেকে একমাত্র আল্লাহর বান্দা মনে করে আল্লাহর মনোনীত পথ ও পন্থা অনুসারে কাজ করে থাকে এবং আখেরাতে জবাবদিহির চেতনা বিবেচনায় রেখে তা করে থাকে তাহলে সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে গেলো। এ বিষয়টি আল কুরআনুল মাজিদে এত বেশী জায়গায় ও এত বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, এখানে উল্লেখ করা সম্ভব হলো না।

মহান আল্লাহ এই পরীক্ষার জন্য প্রথমত: আমাদেরকে শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তির অধিকারী করেছেন যা উল্লেখিত আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘এর উদ্দেশ্যে আমি তাকে শ্রবণশক্তি এবং দৃষ্টিশক্তির অধিকারী করেছি।’ এর প্রকৃত অর্থ হচ্ছে বিবেক-বুদ্ধি।

অর্থাৎ ‘আমি তাকে শ্রবণশক্তি এবং দৃষ্টিশক্তির অধিকারী করেছি” মানে বিবেক-বুদ্ধি দান করেছি। আরবী ভাষায় অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা জানেন যে, জন্তু জানোয়ারের বেলায় এ দুটি শব্দ ব্যবহৃত হয় না। অথচ জন্তু-জানোয়ারেরাও শুনতে পায় এবং দেখতে পায়। অতএব, এখানে শোনা ও দেখার অর্থ শোনার ও দেখার সেই শক্তি নয় যা জন্তু-জানোয়ারকেও দেয়া হয়েছে। এখানে এর অর্থ হলো, শোনা ও দেখার সেসব উপায়-উপকরণ যার সাহায্যে মানুষ জ্ঞান অর্জন করে এবং সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। তাছাড়া শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি যেহেতু মানুষের জ্ঞানার্জনের উপায়-উপকরণের মধ্যে সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ তাই সংক্ষেপে এগুলোর উল্লেখ করা হয়েছে। এ জন্য আমরা প্রায়শই বলে থাকি যে,‘দেখে-শুনে কাজ করিও’ দেখে-শুনে সিদ্ধান্ত নিও’ ইত্যাদি। মুলত এর অর্থ হলো জ্ঞান-বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করো এবং জ্ঞান-বুদ্ধি খাটিয়ে সিদ্ধান্ত নিও। মানুষকে যেসব ইন্দ্রিয় ও অনুভূতি শক্তি দেয়া হয়েছে তার ধরণ প্রকৃতিগত দিক দিয়ে পশুদের ইন্দ্রিয় ও অনুভূতি শক্তি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।

কারণ মানুষের প্রতিটি ইন্দ্রিয়ের পেছনে একটি চিন্তাশীল মন-মগজ বর্তমান যা ইন্দ্রিয়সমূহের মাধ্যমে লব্ধ জ্ঞান ও তথ্যসমূহকে একত্রিত ও বিন্যস্ত করে তা থেকে ফলাফল বের করে মতামত স্থির করে এবং এমন কিছু সিদ্ধান্ত করে যায় যার ওপরে তার কার্যকলাপ ও আচরণের ভিত্তি স্থাপিত হয়। তাই মানুষকে সৃষ্টি করে আমি তাকে শ্রবণশক্তি এবং দৃষ্টিশক্তির অধিকারী করেছি।” কথাটি বলার অর্থ দাঁড়ায় এই যে, আল্লাহ তা’আলা তাকে জ্ঞান ও বিবেক-বুদ্ধির শক্তি দিয়েছেন যাতে সে পরীক্ষা দেয়ার উপযুক্ত হতে পারে। আর যদি আয়াতটির অর্থ শুধু ‘শ্রবণশক্তি এবং দৃষ্টিশক্তি’ করা হয়, তাহলে অন্ধ ও বধির ব্যক্তিরা এই পরীক্ষা থেকে বাদ পড়ে যায়। অথচ জ্ঞান ও বিবেক-বুদ্ধি থেকে যদি কেউ পুরোপুরি বঞ্চিত না হয় তাহলে তার এ পরীক্ষা থেকে বাদ পড়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না। মানুষের পরীক্ষা নেয়ার জন্য দ্বিতীয় যে বিষয় দান করেছেন তাহলো, ‘আমি তাকে পথ দেখিয়ে দিয়েছি। এরপর হয় সে শোকরগোজার হবে নয়তো হবে কুফরের পথ অনুসরণকারী।’ (সুরা আদ দাহর : ৩)।

অর্থাৎ আল্লাহ তা’আলা মানুষকে জ্ঞান ও বিবেক-বুদ্ধি দিয়েই ছেড়ে দেননি। বরং এগুলোর পাশাপাশি তাকে পথও দেখিয়েছেন যাতে সে জানতে পারে শোকরিয়ার পথ কোনটি এবং কুফরীর পথ কোনটি। এরপর যে পথই সে অবলস্বন করুক না কেন তার জন্য সে নিজেই দায়ী। এ বিষয়টি সুরা বালাতে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে ‘আমি কি তাকে দু’টি সুস্পষ্ট পথ দেখাইনি?’ (আয়াত : ১০)। সুরা আশ শামসে বিষয়টি বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে ‘শপথ প্রবৃত্তির আর সে সত্তার যিনি তাকে আভ্যন্তরিন শক্তি দিয়ে শক্তিশালী করেছেন। আর পাপাচার ও তাকওয়ার অনুভূতি দু’টোই তার ওপর ইলহাম করেছেন।’ (আয়াত : ৮)। (চলবে)


বিভাগ : ইসলামী জীবন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

ফিলিস্তিনে আল্লাহর সাহায্য কতদূরে
এআই দিয়ে ঘিবলি স্টাইল কার্টুন তৈরি ইসলামের দৃষ্টিতে জঘন্য অপরাধ
মুসলিম জাতির শক্তির ভিত্তি
ছারছীনা দরবারের দীনী খিদমত ও সংস্কারমূলক কার্যাবলি
যেভাবে হজের প্রস্তুতি নেব
আরও
X
  

আরও পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সউদী আরবের ৩০০ বিলিয়ন ডলারের ঐতিহাসিক চুক্তি

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সউদী আরবের ৩০০ বিলিয়ন ডলারের ঐতিহাসিক চুক্তি

সিরিয়ার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলেন ট্রাম্প

সিরিয়ার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলেন ট্রাম্প

গাজায় যুদ্ধ থামবে না, হুঁশিয়ারি নেতানিয়াহুর

গাজায় যুদ্ধ থামবে না, হুঁশিয়ারি নেতানিয়াহুর

ইসরায়েলি নৃশংস হামলায় গাজায় নিহত অন্তত ৮১ ফিলিস্তিনি

ইসরায়েলি নৃশংস হামলায় গাজায় নিহত অন্তত ৮১ ফিলিস্তিনি

কালিগঞ্জে প্রশাসনের নাকের ডগায় অবৈধ বালু উত্তোলন, পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্ভাবনা

কালিগঞ্জে প্রশাসনের নাকের ডগায় অবৈধ বালু উত্তোলন, পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্ভাবনা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি-প্রক্টরের পদত্যাগ চায় ছাত্রদল

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি-প্রক্টরের পদত্যাগ চায় ছাত্রদল

রিয়াল ছেড়ে কেন ব্রাজিলে আনচেলত্তি

রিয়াল ছেড়ে কেন ব্রাজিলে আনচেলত্তি

দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে নিহত ঢাবি ছাত্রদল নেতা, বিক্ষোভ প্রতিবাদে উত্তাল ক্যাম্পাস

দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে নিহত ঢাবি ছাত্রদল নেতা, বিক্ষোভ প্রতিবাদে উত্তাল ক্যাম্পাস

সেমি-ফাইনালে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ নেপাল

সেমি-ফাইনালে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ নেপাল

এই প্রথমবারের মতো  ‘বাবার কারাবাস’ নিয়ে প্রকাশ্যে  কথা বললেন ইমরান খানের সন্তানদ্বয়

এই প্রথমবারের মতো ‘বাবার কারাবাস’ নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বললেন ইমরান খানের সন্তানদ্বয়

আমিরাতের উন্নয়নে বাংলাদেশিদের অবদানের প্রশংসা এবং সহযোগিতার আগ্রহ প্রকাশ

আমিরাতের উন্নয়নে বাংলাদেশিদের অবদানের প্রশংসা এবং সহযোগিতার আগ্রহ প্রকাশ

কৃষিপণ্য রপ্তানিতে ভাটা, উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা

কৃষিপণ্য রপ্তানিতে ভাটা, উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা

ব্রিফিংয়ে জয়সোয়াল আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার ঘটনায় ভারতের উদ্বেগ!

ব্রিফিংয়ে জয়সোয়াল আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার ঘটনায় ভারতের উদ্বেগ!

আমদানি বৃদ্ধি ও শুল্ক কমানোর পণ্য তালিকা চূড়ান্ত হচ্ছে

আমদানি বৃদ্ধি ও শুল্ক কমানোর পণ্য তালিকা চূড়ান্ত হচ্ছে

আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপন মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ করে না: প্রেস উইং

আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপন মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ করে না: প্রেস উইং

আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপন মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ করে না: প্রেস উইং

আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপন মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ করে না: প্রেস উইং

চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে পতিত সরকারের করা চুক্তি স্থগিত করুন

চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে পতিত সরকারের করা চুক্তি স্থগিত করুন

কমলো উড়োজাহাজের তেলের দাম

কমলো উড়োজাহাজের তেলের দাম

লিবিয়ায় ভয়াবহ সংঘর্ষ, বাসিন্দাদের ঘরে থাকার নির্দেশ

লিবিয়ায় ভয়াবহ সংঘর্ষ, বাসিন্দাদের ঘরে থাকার নির্দেশ

আমরা কি নতুন কোনও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে যাচ্ছি? প্রশ্ন মেজর হাফিজের

আমরা কি নতুন কোনও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে যাচ্ছি? প্রশ্ন মেজর হাফিজের